বর্ষাকালে ভারতের উত্তরাঞ্চলের উত্তরাখন্ডে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স (Valley of Flowers) এ বসে ফুলের জলসা। যোশিমঠ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঘানঘারিয়া থেকে এই ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’ – এর এলাকা শুরু। প্রায় ১২,১০০ ফিট উচ্চতায় ৮৭ স্কোয়ার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই ভ্যালী। স্থানীয় মানুষদের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফুলোঁ কি ঘাটী’, সেই ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স এ ৫২১ রকম প্রজাতির লতা, গুল্ম ও বৃক্ষের আবাসস্থল। ৩০০ প্রজাতির ফুল ফোটে এখানে। পার্বত্য আলপাইন ফুল এবং অন্যান্য বিরল প্রজাতির উদ্ভিদও এখানে দেখা যায়। ঘাংঘারিয়ার বন অফিস বা ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এর কনজারভেশন প্রজেক্ট অফিস থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় যা একটু জেনে গেলে ফুল চিনতে সুবিধা হয়। সঙ্গে এক জন ফুল বিশেষজ্ঞ গাইড নিলে সুবিধা হয়।
ভারতের উত্তরাখণ্ডে ভিউন্দর বুগিয়াল আর সিকিমের ইয়ুমথামের কাছে যে ইয়ুমথাম উপত্যকা আছে সেখানে ফুলের সংখ্যা ও বিভিন্নতা জগতে আর কোথাও অলব্ধ। দুটিকেই ফুলের উপত্যকা বলা যায়, কিন্তু পৃথিবীতে ফুলের উপত্যকা বা ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স বলতে ভিউন্দর উপত্যকাকেই বোঝায়।
- উচ্চতাঃ ১৪০০০ ফুট
- মোট দূরত্বঃ ৭ কিলোমিটার (ওয়ান ওয়ে ট্রেইল)
- ট্রেক সময়কালঃ ২ দিন
- বেইসক্যাম্পঃ গোবিন্দঘাট
- সেরা সময়ঃ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর
সৌন্দর্যের ডালি মেলে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স মানুষকে আহ্বান করছে যেমন তেমনি এই সৌন্দর্যের আড়ালে আছে বিপদের হাতছানিও। কারণ এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এ বাস করে কালো ভাল্লুক থেকে ‘স্নোপার্ড লেপার্ড’, ‘মাস্ক ডিয়ার’।
শুধু ফুল নয়, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এর যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে নানা ধরণের ঔষধির গাছ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— বিরচ, রডোডেনড্রন এবং ব্রহ্ম কমল। প্রচলিত আছে, রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় যখন লক্ষণ আহত হয়ে পড়েন তখন হনুমান সঞ্জীবনীর খোঁজ করতে এখানে এসেছিলেন। হনুমান এখানকার পাহাড় থেকে সঞ্জীবনী নিয়ে গিয়েছিলেন।
ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি চারটি নতুন ট্রেক রুট খুলে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল কুন্থখাল-হনুমানচট্টি ট্রেক রুট। ৪৫ বছর বন্ধ থাকার পর এটি ২০১৫ সালে খুলে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টি হল লতা গ্রাম থেকে ডিব্রুঘেতা ট্রেক রুট। জোশীমঠ থেকে ১৫ কিমি দূরে লতা গ্রাম আসা যায় গাড়িতে। তৃতীয় রুটটি হলো দ্রোণগিরির পাথুরে পথ ধরে ১৩ কিমি। এখানে ট্রেকাররা কাক ভূষণ্ডি তালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। আর চতুর্থ ট্রেকিং রুটটি ৩২০০ মিটার থেকে ৪০০০ মিটার উচ্চতায় চেনাব উপত্যকা দিয়ে।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেকের সেরা সময়
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেকের সেরা সময় – জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। জুনের শুরুতে ভ্যালির গেট খুলে দেয়। তবে দেখার সেরা সময় হলো জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ।
জুলাই মাসে প্রচুর সবুজের দেখা মিলবে তবে পুরো দমে বৃষ্টি শুরু না হওয়া পর্যন্ত কিছুটা তুষারপাতও পেতে পারেন। বর্ষা জুলাই মাসে শুরু হয়, শুধুমাত্র জুলাইয়ের পরে বৃষ্টি তুষার ধুয়ে দেয়। কিন্তু প্রথমার্ধে খুব একটা বৃষ্টি হয় না। জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে বর্ষা গতি পায়। তুষারও ততক্ষণে ধুয়ে যেতে শুরু করে।
আগস্টে, মেঘ কম থাকে এবং এই সময়ে উপত্যকায় সর্বাধিক ফুল ফোটে। এই সময়ে গোবিন্দঘাটে আপনি ভালো পরিমাণে বৃষ্টিপাতের দেখা পেলেও উপরের দিকে সেটা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে পরিণত হবে।
আগস্ট মাসের দ্বিতীয়ার্ধে ফুলগুলি শুকিয়ে যেতে শুরু করে এবং সেপ্টেম্বর মাসে খুব কম ফুলের দেখা মিলে। কিন্তু বর্ষার শেষের পরের একটা অন্যরকম সৌন্দর্য্য আছে। এ সময়টাতে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করে এবং আপনি কিছু পরিষ্কার পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে পাবেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের ওই সময়টাতে তীর্থযাত্রীরা হেমকুন্ড সাহেবের গুরুদ্বার দেখতে ভিড় জমায় ।
টিকেট মুল্য
ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ার্স এ ঢোকার সময় একটা পারমিট নিতে হয়, সেটা গাইডরা করিয়ে দেয়, ছবি ও ভোটার কার্ডের / পাসপোর্টের ফটোকপি লাগে। এখানে জনপ্রতি ৬৫০ টাকার (ভারতীয় হলে ১৫০ টাকা) টিকিট কেটে উপত্যকায় ঢুকতে হয়।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যাওয়ার উপায়
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে দুন, উপাসনা বা কুম্ভ এক্সপ্রেসে হরিদ্বার। হরিদ্বারকে উত্তরাখন্ডের গেটওয়ে বলা হয়। হরিদ্বার থেকে টাটা সুমো রির্জাভ করে গোবিন্দঘাট চলে যান। ভাড়া নিবে আনুমানিক ৭২০০-৮০০০ রুপী। চাইলে রাতে চামোলিতে থেকে যেতে পারেন। চামোলি থেকে গোবিন্দঘাট ৩ ঘন্টার দূরত্ব।
অথবা হরিদ্বার থেকে সরাসরি বাস বা ভাড়া গাড়িতে যোশিমঠ চলে যেতে পারেন। ওখানে রাত কাটিয়ে সকালে আধ ঘণ্টার দূরত্বে গোবিন্দঘাট।
গোবিন্দঘাট থেকে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে। বেলা তিনটার পর আর সেই অনুমতি দেয়া হয় না। অনুমতি মিললে নাম এন্ট্রি করার পর একটা স্টিকারযুক্ত কার্ড দিবে। ওখান থেকে ৩৫ রুপি করে প্রতিজনের ভাড়ায় জীপে চেপে পুলনা যা মাত্র চার কিমি দূরেই অবস্থিত। পুলনা গিয়ে ঘোড়া নিতে পারেন। ভাড়া পড়বে ৬০০ রুপি করে।
রাতে ঘাংরিয়াতে থেকে যান। রুম ভাড়া পড়বে ১৩০০-১৫০০ রুপি। এবার একটু রেস্ট নিয়ে নিন। কারণ পরের দিন মূল গন্তব্য valley of flowers (vof) যেতে হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিন vof এর উদ্দেশ্যে। ঘাংগারিয়া থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার যাবার পর রাস্তা দুদিকে গেছে। বামে ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ার্স (১২১০০ ফিট) আর সোজা গেছে শিখদের তীর্থস্থান হেমকুন্ড সাহিব (১৪০০০ ফিট)। সকাল আটটায় গেট খুলে দেয়।
প্রথম দিন – গোবিন্দঘাট থেকে ঘাংরিয়া ১-৩ কিলোমিটার। রাস্তায় চড়াই- উতরাই সামান্য।
দ্বিতীয় দিন – ঘাংরিয়া থেকে ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স ৩ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেন
যোশিমঠ, গোবিন্দঘাট, ঘাংরিয়ায় গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের টুরিস্ট লজ। ডাবল বেডের ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। ডর্মিটরিতেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আছে নানা ধরনের হোটেল ও ধর্মশালা।
ট্রেক প্রস্তুতি
বেসিক গিয়ার
- ব্যাক প্যাক এবং রেইন কভার (৫০/৬০ লিটার আরামদায়ক কাঁধের স্ট্র্যাপ সহ)
- ডে প্যাক + রেইন কভার (২০/৩০ লিটার যদি একটি খচ্চর বা পোর্টার ভাড়া করেন)
- ট্রেকিং পোল
- হেড টর্চ
- নেক-গেটার
- সানগ্লাস
- ভালো গ্রিপের ট্রেকিং সু যা ওয়াটারপ্রুভ হলে বেটার
- ৫-৬ জোড়া সুতির মোজা
কাপড়
- ফুল স্লিভ টিশার্ট (কুইক ড্রাই) – ৩/৪টি
- ট্রেক প্যান্ট (সিন্থেটিক) শর্টস, ফিটিং ডেনিম, ক্যাপ্রিস এড়িয়ে চলুন – ২/৩টি
- ফ্লিস জ্যাকেট / পশমী জ্যাকেট – ১টি
- বায়ু এবং জলরোধী (জ্যাকেট এবং প্যান্ট) – ১ জোড়া
- পঞ্চো – ১টি
- ডাউন ফেদার / হলোফিল জ্যাকেট – ১টি
- উলের টুপি – ১টি
- উলের গ্লাভস – ১টি
ব্যক্তিগত
- সানস্ক্রিন ক্রিম
- দ্রুত শুকনো তোয়ালে
- অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল পাউডার
- পানির বোতল
- স্ন্যাকস
- টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, টয়লেট পেপার
- লিপ বাম / চ্যাপস্টিক
- ব্যক্তিগত মেডিকেল কিট
স্বাস্থ্য সচেতনতা
- বিশ্রামে পালস রেট অবশ্যই এর মধ্যে হতে হবে (60 থেকে 90 বিট প্রতি মিনিটে)
- রক্তচাপ রিডিং এর মধ্যে হতে হবে (ডায়াস্টোলিক 75 – 85, সিস্টোলিক 100 – 130 মিমি Hg)
- বিশ্রামে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অবশ্যই এর মধ্যে হতে হবে (প্রতি মিনিটে 12 থেকে 20 শ্বাস)
- লিভার এবং কিডনির সমস্যা থাকা উচিত নয়।
- ডায়াবেটিস মেলিটাস, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা, মৃগী, হার্টের সমস্যা, খুব উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি থাকা উচিত নয়।
- পেসমেকার ইমপ্লান্ট নেই।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেকে কি অফলোডিং পাওয়া যায়?
জ্বি, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেকে অফলোডিং খরচ ৬০০ টাকা।