ভোলাগঞ্জ (Bholaganj) সিলেটের আর একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। সাদা পাথর, রোপওয়ে, পাথর কোয়ারী আর পাহাড়ী মনোলোভা দৃশ্য উপভোগ করার জন্য এখানে প্রতিদিনই আগমন ঘটে পর্যটকদের। সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। ভারতের আসাম প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ে এক সময় লোকজন এ রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করতো। কালের পরিক্রমায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রজ্জুপথ। নাম ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। দেশের সর্ববৃহৎ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীর অবস্থানও এই এলাকায়। রোপওয়ে, পাথর কোয়ারী আর পাহাড়ী মনোলোভা দৃশ্য অবলোকনের জন্য এখানে প্রতিদিনই আগমন ঘটে পর্যটকদের।
কখন যাবেন
মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায় যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
ভোলাগঞ্জ এর দর্শনীয় স্থান
ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে
ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সাথে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। এই পাথর দিয়ে পঞ্চাশ বছর চালানো যাবে- এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। বৃটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্লান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। দু’প্রান্তে ডিজেল চালিত দুটি ইলেকটৃক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী , স্কুল,মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভুক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্লান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সংশিষ্টরা জানান, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, পাথরের অপর্যাপ্ততা ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে এক্র্ক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। আগে উত্তোলিত পাথর ভাঙ্গা, ধোয়া ও টুকরোর আকার অনুসারে বালু, স্টোন চিপস ও ট্রাক ব্যালাস্ট ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। শ্রেণী অনুসারে সেগুলো পৃথক পৃথকভাবে বের হয়ে রোপওয়েতে ঝুলানো চারকোনা বিশিষ্ট ষ্টীলের বাকেটে জমা হতো। প্রতিটি বাকেটের ধারণ ক্ষমতা ২৩৭ কেজি (প্রায় ১২০ ফুট)। পাথর ভর্তি বাকেট পাঠানো হতো ছাতকে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঠিকাদাররা স্থানীয়ভাবে বোল্ডার পাথর ক্রয়ের পর তা ভেঙ্গে বিভিন্ন সাইজে বিভক্ত করে। তারপর তা বাকেটে পুরে ছাতকে প্রেরণ করা হয়। মজার ব্যাপা হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে-পিয়াইন নদীর সাথে। রোপওয়ের আয়তন প্রায় একশ’ একর। আর এ কারণেই স্থানটি পর্যটকদের কাছে এত আকর্ষণীয়।
পাথর আহরণের দৃশ্য
ভোলাগঞ্জ কোয়ারীতে শুষ্ক মওসুমে প্রধানত গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারীর ওপরের বালি অপসারণ করে। পর্যায়ক্রমে গর্ত খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭/৮ ফুট নিচু গর্ত খোঁড়ার পর কোয়ারীতে পানি উঠে যায়। পানি উঠে গেলে শ্যালো মেশিন দিয়ে কোয়ারীর পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরে ‘শিবের নৌকা’ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছে-একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নীচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। সংশিষ্টরা ঝঁকির সাহায্যে পাথর নৌকায় তুলে। এ পদ্ধতিতে সহস্রাধিক শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে থাকে। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও খুব উপভোগ্য।
ভোলাগঞ্জ ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন
ভোলাগঞ্জে রয়েছে একটি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন। এ স্টেশন দিয়ে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চলে। এ স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা প্রধানত চুনাপাথর আমদানী করে থাকেন। চুনাপাথর নিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তের জিরো লাইনে এ কাস্টমস স্টেশনের অবস্থান। চুনাপাথর আমদানির দৃশ্য অবলোকনের বিষয়টিও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
ভোলাগঞ্জ যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে সিলেট ট্রেনে চেপে যেতে পারেন। যারা রিলাক্স ট্যুর চান তাদের অনেকেরই প্রথম পছন্দ থাকে ট্রেন। ট্রেনের শোভন চেয়ার এর ভাড়া পড়বে ৩২০ টাকা এর মতো। চাইলে প্রথম শ্রেণীর চেয়ারেও যেতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়বে রাত ৯.৩০-১০ টায় এবং সিলেটে গিয়ে পৌঁছায় সকাল ৬ টায়। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে চলে যাবেন পানসী রেস্টুরেন্ট, ভাড়া নিবে ৪০ টাকা। সেখানে নাস্তা করে ৮ থেকে ৮.৩০ এর মধ্যে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট এর সামনে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে নিন। এবার আপনার গন্তব্য হবে আম্বরখানা মজুমদার পয়েন্ট, ভাড়া নিবে ৪০ টাকা। মজুমদার পয়েন্ট পৌছে দেখবেন বি আর টি সি দোতলা বাস আছে বা আম্বরখানা মজুমদার পয়েন্ট পৌছে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। BRTC এর এই দোতলা বাস আপনাকে সরাসরি ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ট্রলার ঘাট নিয়ে যাবে, ভাড়া নিবে জন প্রতি ৬০ টাকা। এক ঘন্টার মতো সময় লাগবে। ১ ঘন্টা পর পর বাস ভোলাগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
সাদা পাথর (Sada Pathor) ট্রলার ঘাট পৌঁছালেই দেখবেন অনেক ট্রলার আছে। নির্ধারিত ট্রলার রিজার্ভ ভাড়া ৮০০ টাকা। দুই বা এক জনের জন্য রিজার্ভ করার কোন প্রয়োজনে পড়ে না। আপনি যে কোনো গ্রুপ এর সাথে যোগ হয় যেতে পারবেন। এক ট্রলারে ৮ জন যাওয়া যায় সেই হিসাবে জন প্রতি খরচ পড়বে ১০০ টাকা। ট্রলারে করে চলে যাবেন সাদা পাথর। আপনি সেখানে ২ ঘণ্টা থাকতে পারবেন। কারণ ট্রলার রিজার্ভ করা থেকে ২ ঘণ্টার জন্য।আপনকে আবার ওই একই ট্রলারে ফিরতে হবে। আপনি বাড়তি জামাকাপড় নিয়ে যেতে পারেন গোসল করার জন্য। জমা কাপড় পরিবর্তন করার জন্য ভালো ব্যাবস্থা আছে। নারী পুরুষ উভয়েরই ১৫ টাকা জন প্রতি নিবে। টয়লেট, ওয়াসরুম এর ভালো ব্যাবস্থা আছে। আপনার ঘোরাফেরা শেষ করে একই ট্রলারে চলে আসেন ঘাটে।
বেসিক খাবার হিসেবে সকালে আপনি মুরগি খিচুরি খেতে পারেন ৪০ টাকা করে প্লেট। আর দুপুরে আপনি ভাত বা বিরিয়ানি যাই খান সেটা আপনার উপর নির্ভর করে, তবে ৩০০ টাকার মধ্যে আপনি ভালো খাবার খেতে পারবেন। তাহলে দুই জনের খরচ মোট হিসাব করলে দাড়ায় খাবার বাদে ২০৪০ টাকা।
বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য সবথেকে সহজ উপায় হলো আম্বরখানা বাস স্ট্যান্ড থেকে :
- সাদাপাথর ট্যুরিস্ট বাস-৭০ টাকা
- বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস – ৬০টাকা
যারা রিলাক্স ট্যুর দিতে চান
বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে সিলেট শহরের কদমতলী আসতে হবে। কদমতলী থেকে আম্বরখানা পয়েন্টে আসতে হবে। আম্বরখানা পয়েন্ট থেকেই ভোলাগঞ্জের সি এন জি পাবেন। কদমতলী থেকে নেমে রিক্সায় আম্বরখানা পয়েন্টে যেতে পারেন, ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। আম্বরখানা থেকে ভোলাগঞ্জ ট্রলার ঘাট পর্যন্ত সিএনজি জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে শুধু যাওয়া। চাইলে রিজার্ভও যাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে যাওয়া আসা মিলে ১২০০/১৫০০ টাকা। তবে অবশ্যই দরদাম করে নিতে হবে। ভোলাগঞ্জ সি এন জি দিয়ে যাওয়ার পরে আপনাকে জিরো পয়েন্টে সাদাপাথর (Zero Point) যেতে হলে নৌকা ভাড়া করতে হবে। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা।
তবে এক্ষেত্রে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে ৫ জনের গ্রুপ গেলে খরচ কমে যাবে অনেকাংশে।
কোথায় থাকবেন
জেলা পরিষদের একটি রেস্ট হাউস আছে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তত্তবধানে। থাকতে হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমতি নিতে হয়। এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ বা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় থাকার জন্য তেমন কোন ভাল ব্যবস্থা নাই। আপনি ভোলাগঞ্জ দর্শন শেষ করে সিলেটে এসে অবস্থান করতে পারবেন।