লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান (Lawachara National Park) মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এখানে প্রকৃতি তার সেৌন্দর্য ভান্ডার অকৃপন ভাবে বিতরণ করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পালা, বিচিত্র রকমের বন্য প্রাণী যেমন- হরিণ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির শাপ, বন মোরগ, মেছো বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরহরিৎ ও মিশ্রচিরহরিৎ বন যার আয়তন ১২৫০ হেক্টর।
জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ‘ ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই বনে। বন ঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে, ঠিক সেখানেই হয়েছে ছবিটির কিছু দৃশ্যের শুটিং। ছবিটির একটি দৃশ্য ছিল এ রকম – ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপনমনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। কামরা থেকে নেমে আসেন নায়ক ডেভিড নিভেন, ব্যাপারটা কী দেখতে। সামনের গ্রামেই তখন হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচান। মেয়েটি হলো শার্লি ম্যাক্লেইন। ছবির এই অংশটুকুই চিত্রায়িত হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়।
জীব বৈচিত্র
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সেগুন, চাপালিশ, আগর, রক্তন সহ মোট ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিত, ০৪ প্রকার উভচর প্রাণী, ০৬ প্রজাতির সরিসৃপ ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।
বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত আফ্রিকান টিকওক গাছটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আছে। পৃথিবীর মাত্র চারটি দেশে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক পাওয়া যায় এবং বাংলাদেশের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেই সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় এই উল্লুক দেখা যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনরুই, অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সহ প্রায় ২৭৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে। এই উদ্যানের ভিতর রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাসিয়াপুঞ্জি, যারা ধারন করে আছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
লাউয়াছড়া ভ্রমণ
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতর রয়েছে এক, দেড় ও তিন ঘন্টার তিনটি ট্রেইল, যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারে। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার পথ, একটি ১ ঘণ্টার পথ আর অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তৈরি করা এ তিনটি পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছপালা, পাখি ও অর্কিড। ভাগ্য ভালো হলে হনুমান, বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন লাউয়াছড়ায় প্রকৃতি ভ্রমণে আসেন। বছরজুড়েই এই বনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও শীতের সময় সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়।
আধ ঘণ্টার ট্রেকিং: এ পথটির শুরু রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। এ পথের শুরুতে উঁচু উঁচু গাছগুলোতে দেখা মিলতে পারে কুলু বানরের। নানা রকম গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে তৈরি করা এ হাঁটা পথটিতে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন যে কেউ। এ ছাড়া এ পথের বড় বড় গাছের ডালে দেখা মিলবে বুনো অর্কিড। যদিও এ সময়টা অর্কিডে ফুল ফোটার সময় নয়। নির্দেশিত পথে হাতের বাঁয়ে বাঁয়ে চলতে চলতে এই ট্রেইলটির শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানেই।
তিন ঘণ্টার ট্রেকিং: তিন ঘণ্টার হাঁটা পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর। এ পথের বাঁয়ে খাসিয়াদের বসত মাগুরছড়া পুঞ্জি। এ পুঞ্জির বাসিন্দারা মূলত পান চাষ করে থাকেন। ১৯৫০ সালের দিকে বনবিভাগ এ পুঞ্জি তৈরি করে। এ পথে দেখা মিলবে বিশাল বাঁশবাগান। এ বাগানে আছে কুলু বানর আর বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর। লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী। এরা দিনের বেলায় বাঁশের ঝারে ঘুমিয়ে কাটায়। এ ছাড়া এ পথে দেখা মিলবে নানান প্রজাতির পাখির, আর পথের শেষের দিকে দেখা মিলতে পারে এ বনের অন্যতম আকর্ষণ উলস্নুক পরিবারের। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।
লাউয়াছড়া উদ্যানের প্রবেশমূল্য
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্ক ২০ টাকা, ছাত্র ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ১০ টাকা, বিদেশি নাগরিক পাঁচ মার্কিন ডলার কিংবা সমমূল্যের টাকা। এছাড়া গাড়ি, জীপ ও মাইক্রোবাস পার্কিং ২৫ টাকা। তাছাড়া গাইড নিতে চাইলে ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত তিন ক্যাটাগরির গাইড পাওয়া যায়। পিকনিক স্পট ব্যবহার জন প্রতি ১০ টাকা। ভিতরে বা আশে পাশে খাবারের কোন ব্যবস্থা নাই, নিজ দায়িত্বে করে নিতে হবে।
লাউয়াছড়া কিভাবে যাবেন
লাউয়াছড়া যেতে হলে প্রথমে ট্রেন বা বাসে করে শ্রীমঙ্গল অথবা কমলগঞ্জে আসতে হবে। ঢাকা থেকে রেল ও সড়ক পথে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ টাকা থেকে ৭৬৫ টাকা।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সোয়া ৮টায় ছাড়ে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টায় ছাড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪০ টাকা থেকে ৯৪৩ টাকা।
শ্রীমঙ্গল থেকে সিএনজি করে যেতে পারেন। যাওয়া আসা ঘণ্টা খানিক থাকা সব মিলিয়ে ৬০০ এর কম না। যোগাযোগঃ টুকু ভাই – ০১৭১০৩৮৩৫৬১। জিপ এ গেলে ভাড়া বেশী। যোগাযোগঃ আফজাল – ০১৭৪১০৮৯৭৬৯
বাস এ যেতে হলে রিক্সা করে চলে আসুন ভানুগাছা রোড বাস স্ট্যান্ড , সেখান থেকে বাস ভাড়া ১০ টাকা করে ।
কোথায় থাকবেন
লাউয়াছড়া উদ্যানে থাকবার জন্যে একটি ফরেস্ট রেস্ট হাউজ রয়েছে। বন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনি লাউয়াছড়া রেস্ট হাউজেই থাকতে পারেন। ফোনঃ ০৮৬১-৫২৩৫০
এছাড়া শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো মানের জায়গা ভানুগাছ সড়কে টি-রিসোর্ট (ফোনঃ ০১৭১২-৯১৬০০১ )। অন্যান্য থাকার জায়গার মধ্যে আছে— হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান (পাঁচ তারকা) – ০১৫৫২-৬৮৩৪৫৪, রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট (০১৯৩৮-৩০৫৭০৬), টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল প্লাজা (৮৬২৬৫২৫, ০১৭১১-৩৩২৬০৫), বি.টি.আর.আই – ০৮৬২৬-৭১২২৫ ইত্যাদি। এসব হোটেল ও রিসোর্টের ভাড়া ৫শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার ৫শ’ টাকা।
এছাড়াও কমদামি কিছু হোটেলও আছে যেখানে থাকতে পারেন, খরচ পরবে ৫০০/৮০০ টাকা।